‘জন অ্যারিস্টটল গে ফিলিপ্স’ ছিলেন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এর সাধারন একজন শিক্ষার্থী।
১৯৫৫ সালের অগাস্ট মাসের এক বিকেলে জন্ম নেয়া এই মেধাবী ছেলেটি ছিলেন খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। নিজের অজান্তেই ১৯৭৬ সালে শেষ বর্ষের সম্মান পরীক্ষার প্রোজেক্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেন পারমাণবিক বোমার ডিজাইন। কোন ধরনের সাহায্য ছাড়া, বাজারে সহজলভ্য পদার্থবিদ্যার কিছু বই এবং পুরনো কিছু সরঞ্জাম ব্যাবহার করে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দেন পুরো পৃথিবীতে। সংবাদমাধ্যমে তিনি ‘এ-বম্ব কিড’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা তথা সরকার আগ্রহী হয়ে উঠে তার আবিষ্কৃত বোমার নকশাটি কিনে নেবার জন্য।
ডাঃ ফ্রাঙ্ক ক্লিপটন, ক্যালিফোর্নিয়ার একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নকশাটি দেখে অবাক হয়ে স্বীকার করেন যে ডিজাইনটি আসলেই কার্যক্ষম এবং হিরোশিমা-নাগাসাকি তে ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমার তুলনায় অর্ধেক ধ্বংসক্ষমতা সম্পন্ন। অতঃপর আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই প্রোজেক্ট পেপারটি এবং পরীক্ষামূলক ডিজাইনগুলো তার হলের রুম থেকে বাজেয়াপ্ত করে।
১৯৭৯ সালে ফিলিপ্স তার পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের ঘটনাটি নিয়ে একটি বই রচনা করেন –Mushroom: The True Story of the A-Bomb Kid ISBN0−671−82731−6/ISBN0−688−03351−2
_______________________________________________________________________________________________
শীতের দিনের প্রিন্সটন, কাদা ভর্তি উঠান, বিষণ্ণ দিন। আর আমার অবস্থাও জড়ো-সড়ো। ডাকে আমার পরীক্ষার ফল এসেছে। গ্রেডগুলো সব খারাপ বা ফেলের কোঠায়। সাথে ডীনের একটা সতর্কবাণী – যদি আর একটিবার ফেল করি তাহলে বহিষ্কার।
নতুন সেমিস্টারের শুরুতে অবশ্য সবগুলো কোর্সই আমার ভাল লাগতে শুরু করলো। একটা কোর্সের নাম : ৪৫২ পারমাণবিক অস্ত্র কৌশল ও নিয়ন্ত্রন। এতে আমরা আট জন ছাত্রকে পারমাণবিক যুদ্ধ আর মহাপ্রলয়ের আলোচনায় ব্যস্ত রাখা হত।
এই কোর্সে বিখ্যাত পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যিনি গভীর ভাবে উৎসাহী, বর্ণনা করেন পারমাণবিক বিস্ফোরণের অপেক্ষাকৃত তাৎক্ষনিক প্রভাব সমূহ। ক্লাসে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এরপর কোর্স লিডার হল ফীবেসনের বক্তৃতা :
“ একটা স্থুল অ্যাটম বোমা বানাতে মাত্র ১৫ পাউন্ড প্লুটোনিয়াম লাগে। প্রতি বছর দেশে যে পরিমাণে এই বস্তুটি আসা যাওয়া করে তাতে এরকম হাজার হাজার বোমা বানানো সম্ভব। ধরো একটা চালান চুরি হয়ে গেল, আর দু’সপ্তাহ পরে নিওইয়র্কে বিস্ফোরিত হলো অমনি একটা বোমা। নিহত এক লক্ষ লোক। একটা সন্ত্রাসবাদী দল প্রেসিডেন্ট কে জানালো যে তাদের দাবী না মানা হলে অরকম আরেকটা ফাটানো হবে। প্রেসিডেন্ট কি করতে পারেন ??
একজন ছাত্র বলে উঠলোঃ
“ওটা কখনও হবে না। কারণ অ্যাটম বোমা বানাতে হলে অত্যন্ত মেধাবী হতে হবে।” সবাই তাকে সমর্থন দিল।
কিন্তু সত্যি কি তাই ? হয়ত একজন গড়পড়তা পদার্থবিদ্যার ছাত্রই কাগজে-কলমে কার্যক্ষম একটা বোমা ডিজাইন করতে সক্ষম। হয়ত, আমার মত গড়পড়তার নীচের ছাত্র। তাহলে মার্কিন সরকারকে বুঝানো যাবে প্লুটোনিয়ামের আরো কড়া পাহারার প্রয়োজনীতার কথা। জুনিয়র প্রোজেক্ট হিসেবে করতে হলে, মাত্র তিন মাসের মধ্যে আমাকে এটা করতে হবে। এহেন পাগলামি প্রকল্পে কে আমার উপদেস্টা হতে যাবে? আমি ফ্রিম্যান ডাইসনকে অনুরোধ করলাম, তিনি বললেন,
“তুমি তো জানো সরকারের নিরপত্তা নিয়ম অনুসারে আমি তোমাকে পদার্থবিদ্যার লাইব্রেরীর বইয়ে জা আছে তার বাইরে এ সম্পর্কে কোন খবর দিতে পারিনা।”
“জানি স্যার।”
তিনি রাজি হলেন।
প্রাথমিক কাজ যতই এগুতে লাগলো আঁক-জোকগুলোর প্রতি ফ্রিম্যান এর সাড়া ততই দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে লাগলো। আমি ওয়াশিংটনে গেলাম, লস আলমাস প্রোজেক্ট সম্পর্কে ডিক্লাসিফাইড রেকর্ড সমূহ সংগ্রহ করতে। জাতীয় কারিগরি তথ্য সার্ভিস থেকে আমি এমন সব ঐতিহাসিক বর্ণনা পেলাম যেখানে প্রথম অ্যাটমবোমা গুলোর সমস্যাদি সমাধানের বিস্তারিত বিবরণ আছে। তাছাড়া ১৯৪৩ সালের বসন্তে যে সব নতুন বিজ্ঞানী ওই প্রোজেক্ট এ যোগ দিয়েছেন তাদেরকে দেয়া কাগজপত্রের একটা কপিও আমি পেলাম। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে পারমাণবিক ফিশন ক্রিয়া ঘটাবার ব্যাপারে যত তথ্য জানা ছিল তার সংক্ষিপ্তসার এখানে ছিল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সনের মধ্যে এইসব কাগজকে ডিক্লাসিফাই কড়া হয়েছে গোপনীয়তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে। তখন এই সব কাগজের কপি ২৫ ডলারেই পাওয়া যায়।
ফ্রিম্যান ডাইসন বললেন,
“তোমাকে ওই কাগজগুলো বরং আমার থেকে অনেক বেশী সাহায্য করবে। পাঁচ সপ্তার মধ্যে তুমি বোমার ডিজাইন নিয়ে আশবে এতাই আমি আশা করবো।”
আমি জানি সাফল্য আমার আসবে। কিন্তু কি ভাবে? একটা অ্যাটমবোমা কল্পনা করার চেষ্টা করুন। কেন্দ্রে রয়েছে মার্বেলের আকারের একটা জিনিস। এর চারদিকে বাতাবি লেবু আকারের আরেকটা জিনিস। লেবুর চারদিকে একটা প্রতিফলক বাধা। এর চারদিকে কিছু বিস্ফোরক যা ইলেক্ট্রিক কারেন্ট দিয়ে ট্রিগার করা যায়। বিস্ফোরকগুলো কিভাবে সাজানো থাকবে এই তথ্যটি বোমার গোপনীয় তথ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঠিক কি বিস্ফোরক হবে, ঠিক কিভাবে তা সাজানো থাকবে, তা না দিতে পারলে আমার ডিজাইন এর কোন দাম নেই। আমার কাজের টেবিল এ বই, ক্যালকুলেটর ডিজাইন পেপার নোটের ছড়াছড়িতে ঢেকে গেল। মেঝেতে আমার বিছানাটা পাতা থাকতো। ক্লাসে যাওয়াও বাদ দিয়ে দিলাম।– দিনরাত এই কাজই চললো।
প্রতিটি সমস্যার মোকাবিলায় আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলও একজন সন্ত্রাসবাদীর। একে সস্তা হতে হবে, সরল হতে হবে। আর গাড়ীর পিছনে লুকিয়ে রাখার মত ছোটও হতে হবে। আবার কখনও আমার দৃষ্টিভঙ্গি হয় লস আলমাস এর সেই বিজ্ঞানীদের মত। ওয়াশিংটনে কেনা কারিগরি বর্ণনা সযত্নে অনুসরণ করে আমি তাদের মত একটি একটি অংশের উপর কাজ করতে থাকি। আগে করা হয়েছে এমন একটি বিরাট ধাঁধা আমাকে নতুন করে মেলাতে হচ্ছে। ধাঁধার এক একটা টুকরো তখনো পাওয়া যাচ্ছে না। একটা আভাস পেলেই আমি থার্মোফ্লাক্সে কফি ভরে লেগে যাই তার পেছনে—যতক্ষণ পর্যন্ত শূন্যস্থান পূরণ না হচ্ছে। আর মাত্র দু-সপ্তাহ।
ডিজাইন জমা দেবার মাত্র সাত দিন আগেও আমি বিস্ফোরকের সমস্যার কুল কিনারা পাচ্ছি না। এর মধ্যে যদিও বা উত্তর পাই, সময়মত কাজ কি শেষ করতে পারব? ডিজাইনটা আমাকে গ্রাফ পেপারের অসংখ্য পৃষ্ঠায় নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকতে হবে, এর প্রত্যেকটা অংশকে। তাছাড়া শুধু অ্যাটম বোমার ডিজাইনটাই নয়, আমি আমার ভবিষ্যৎ ও বাজী রেখেছি। এবার যদি কোর্সগুলোতে উঁচু গ্রেড না পাই তা হলে চিরতরে প্রিন্সটন থেকে বিদায়।
মাঝরাত। কাল বিকাল ৫ টার মধ্যে ডিজাইন জমা দিতে হবে। বিস্ফোরণের সাজানো সম্পর্কে আমার নতুন ধারনা হয়ত ঠিক। কিন্তু বিস্ফোরকটির প্রকৃতি সম্পর্কে আমি তখনো জানি না। সকাল দশটার সময় সত্য উদঘাটিত হল। দেলওয়্যারে দ্যু পন্ত কোম্পানির রাসায়নিক বিস্ফোরণ বিভাগের প্রধান এক ব্যক্তিকে আমি টেলিফোন করলাম। তাকে যদি বলি আমি অ্যাটম বোমা ডিজাইন করতে যাচ্ছি তাহলে যা চাচ্ছি তা কখনও পাব না। একটু তো লুকিয়ে আমি যা বললাম তা হলো,
“আমি গোলাকার ধাতুর মধ্যে খুব উচ্চ ঘনত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন বিস্ফোরকের আকৃতি নিয়ে গবেষণা করছি। এ কাজে দেলওয়্যারে দ্যু পন্ত কোম্পানির তৈরি কোন কিছু কাজে লাগতে পারে কি ?”
“অবশ্যই!”
তার গলায় সন্দেহের ভাব আছে বলে মনে হলোনা। তবুও ভাল করে বললাম,
“আমার এক প্রফেসর বলছিলেন উচ্চ ঘনত্তের অবস্থায় নাকি যে কোন সহজ একটা বিস্ফোরক ব্লাঙ্কেটেই কাজ চলতে পারে।”
“না, না আমার তা মনে হয় না, তবে একটাজিনিসেরনামবললেন
ওতে আপনার কাজ হবে বলে মনে হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যা, ওই বিস্ফোরকটার দহনে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যাতে করে এটা ভেতরের দিকে বিস্ফোরিত হবার মতো শক্ত-তরঙ্গ সৃষ্টি করতে সক্ষম”
টেলিফোনটা রেখেই আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। উনি আমাকে ঠিক সেই খবরটাই দিয়ে দিলেন যেটি আমার খুব প্রয়োজন। এখন বিকেল পাঁচটার ভেতর লেখার বাকি অংশটা টাইপ করে ফেলতে হবে।
আমার প্রোজেক্ট সময়সীমার মধ্যে জমা দেয়া হল। এখন তার পুরো নাম দাঁড়ালো “একটি স্থুল প্লুটোনিয়াম ২৩৯ ফিশন বোমা বানাতে সচেষ্ট কোন সন্ত্রাসবাদী দল কিংবা অনিওক্লিয়ার জাতীর মোকাবিলায় সমস্যা ও সম্ভাবনা সমূহের বিবেচনা”
হঠাত মনে হল,মাথাটা অসম্ভব রকম হালকা হয়ে গেল।
এক সপ্তাহ পর পদার্থবিদ্যা বিভাগে ফিরে এলাম প্রোজেক্টটা ফেরত নেবার জন্য। সব সময় একটা চিন্তা মাথায় ছিলঃ বিস্ফোরণের শব্দ তরঙ্গের হিসাবে আমার কোন ভুল হলো নাতো। গ্রাফের কোথাও কোন ভুল নেই তো। যদি হয়, নির্ঘাত ফেল। বিভাগের সেক্রেটারী মহিলাটি আমাকে দেখে চমকে উঠে বলল,
“তুমিই কি সেই ছেলে নও, যে অ্যাটম বোমা ডিজাইন করেছে ? ”
“হ্যা, আমার কাগজটা ফেরত … … ”
ঢোক গিলে তিনি আবার বললেনঃ
“বিভাগে কথা চলছে তোমার কাগজটা সরকারের গোপনীয় বিষয়ে পরিণত করে ফেলা দরকার কিনা”
“তার মানে আমি ফেল করিনি ? ”
“না হে না, পরীক্ষায় একমাত্র A গ্রেড তুমিই পেয়েছো। ”
“ডাঃ ডাইসন তোমাকে খুজে খুজে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। কই, তোমার রুমমেটরাও তো বলতে পারল না তুমি কোথায় ? ”
“আমি মোটর সাইকেল চালাতে বের হয়েছিলাম। ”
“উহু, সেটি বড় বিপজ্জনক। আমরা চাইনা আমাদের বিভাগের তারকাটি দুর্ঘটনায় আঘাত পাক। ”
এসব কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছিল।
“তোমার জন্য একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হচ্ছে বিভাগে। আশা করি তুমি আসতে… … … … । ”
কিছু শুনতে পেলাম না। হঠাত আমার মনে হলো আমি মারাত্মক একটা কিছু করে ফেলেছি। এখানে এই কাগজটুকুর মধ্যে আমি এমন কিছু কৌশল লিখে দিয়েছি যার দ্বারা হাজার হাজার লোককে হত্যা করা সম্ভব। আর আমার একমাত্র চিন্তা কিনা আমি ফেল করলাম কি পাস করলাম তাই নিয়ে!!!
_______________________________________________________________________________
মুল লেখাঃ Mushroom: The True Story of the A-Bomb Kid
অনুবাদঃ মুহাম্মদ ইব্রাহীম
মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী