বারি জারবেরা-১ : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে 'বারি জারবেরা-১' জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাতটি বাংলাদেশের সর্বত্র চাষাবাদ উপযোগী।
জারবেরা দ্রুতবর্ধনশীল বহুবর্ষজীবী হার্ব। গাছ রোমাকৃত (Hairy) এবং ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। জারবেরা কা-হীন, পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং পাতার কিনারা খাঁজযুক্ত। ফুলের রঙ গাঢ় লাল, কেন্দ্র হালকা সবুজাভ এবং ৯.৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জারবেরা সারা বছর চাষ করা যায়, তবে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়। চারা লাগানোর পর থেকে ১০০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। প্রতি ঝাড়ে এক বছরে ২০ থেকে ২৫টির মতো ফুল ফোটে এবং হেক্টরপ্রতি ফলন ৯ থেকে ৯.৫ লাখ। ফুলের সজীবতা থাকে ৮ থেকে ৯ দিন।
বারি জারবেরা-২ : বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। পাতার রঙ হালকা সবুজাভ এবং গভীর খাঁজযুক্ত। গাছ কান্ডহীন, রোমাবৃত এবং ৩০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুলের রঙ সাদা এবং ৯ থেকে ৯.৫ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট। প্রতিটি পুষ্পদন্ডের ওজন ১৪ থেকে ১৫ গ্রাম। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতটি চাষ করা যায়। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারা বছর চারা লাগানো যেতে পারে, তবে শীত মৌসুম অর্থাৎ অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়। চারা লাগানোর পর ৮০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। প্রতি ঝাড়ে এক বছরে ২২ থেকে ২৫টির মতো ফুল জন্মায় এবং হেক্টরপ্রতি ফলন ৯.৫ থেকে ১০ লাখ।
জারবেরার উৎপাদন প্রযুক্তি
উপযুক্ত মাটি : সুনিষ্কাশিত, উর্বর দোঅাঁশ বা বেলে দোঅাঁশ মাটি জারবেরা চাষের জন্য উত্তম। মাটির pH মাত্রা ৫.৫ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকা উচিত।
বংশবৃদ্ধি
ক. বীজের মাধ্যমে : বীজের মাধ্যমে জারবেরার বংশবৃদ্ধি করা যায়। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত গাছে মাতৃগাছের সব গুণাবলি বজায় থাকে না, তবে পদ্ধতিটি সহজ।
খ. ডিভিশন : মাতৃগাছের ক্লাম্প বিভক্ত করে বংশবৃদ্ধি করা যায়। এজন্য মাঠের সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিপূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছগুলো ছোট ছোট ভাগে ধারালো ছুরি দিয়ে ভাগ করা হয়। ওই সাকারগুলোর পাতা ও শিকড় হালকা পরুনিং করে পরবর্তীকালে নতুন বেডে লাগানো হয়।
গ. মাইক্রোপ্রোপাগেশন : বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে ওপরের পদ্ধতি দুটি খুব উপযোগী নয়। অল্প সময়ে প্রচুর সংখ্যায় রোগমুক্ত চারা পাওয়ার জন্য টিস্যুকালচার পদ্ধতিটি উত্তম। এজন্য প্রথমে সঠিক জাত নির্বাচন করতে হবে। পরে ওই গাছের কান্ডের বর্ধিত অগ্রাংশ (Growing shoot tips) , ফুল কুঁড়ি (Flower bud) , পাতা (Leaf) ইত্যাদিকে এঙ্পান্ট (Explants) হিসেবে নিয়ে বার বার সাব-কালচার (Sub-Culture) করে অসংখ্য চারা উৎপাদন করা সম্ভব।
চাষাবাদ
ক. জমি তৈরি : জমিতে পরিমাণমতো জৈব সার দিতে হবে, তারপর ৪০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার গভীর করে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে পরপর কয়েকটি চাষ দিয়ে জমি ঝুরঝুরা করে তৈরি করতে হবে।
খ. বেড তৈরি : জারবেরার জন্য বেডের উচ্চতা ২০ সেন্টিমিটার এবং প্রশস্ততা ১.০ থেকে ১.২ মিটার হলে ভালো হয়। জমিতে যেন পানি জমে না থকে, সেজন্য দুই বেডের মধ্যবর্তী ৫০ সেন্টিমিটার পানি নিষ্কাশন নালা থাকতে হবে। সাধারণত একবার লাগিয়ে পর্যায়ক্রমে দুই বছর ফুল আহরণ করা হয় বলে জমি ও বেড তৈরির সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়।
গ. চারা লাগানো : বেড তৈরি হলে জাত ও এর বৃদ্ধির ধরন বুঝে সাকারগুলো ৫০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে লাগাতে হয়। সারি থেকে দূরত্ব ৫০ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার। চারাগুলো এমনভাবে মাটিতে স্থাপন করতে হবে যেন চারার ক্রাউন মাটির ওপরে থাকে। ক্রাউন মাটির নিচে গেলে গোড়া পচা রোগ সংক্রমণের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়।
ঘ. লাগানোর সময় : নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারা বছর চারা লাগানো যেতে পারে, তবে শীত মৌসুম অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়।
ঙ. পানি দেয়া : জারবেরার শিকড় গভীরে প্রবেশ করে বিধায় বার বার হালকা স্প্রিংকলার সেচের পরিবর্তে প্লাবন সেচ দেয়া উত্তম। পানি সেচের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়। কারণ জারবেরা ক্ষেতে জলাবদ্ধতা মাটিবাহিত রোগ সংক্রমণ ত্বরান্বিত করে। আমার মাটিতে পানির অভাব হলে গাছ ঢলে পড়ে, সেক্ষেত্রে ফুলের পুষ্পদ- ছোট হয়ে যায়।
চ. সার প্রয়োগ : জারবেরা দ্রুতবর্ধনশীল একটি ফুল ফসল। গাছের সুবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ ও গাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিক্রমায় পরিমিত পরিমাণ সার প্রায়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর পর নতুন শিকড় গজানো শুরু হলে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। সেজন্য সারের মাত্রা নির্ধারণ ও প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জারবেরাতে সার প্রয়োগের মাত্রা হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ-
সারের নাম প্রয়োগ মাত্রা (হেক্টরপ্রতি)
পচা গোবর/কম্পোস্ট ১০০০০ কেজি
কোকোডাস্ট ২০০০ কেজি
ইউরিয়া ৩৫০ কেজি
টিএসপি ২৫০ কেজি
এমপি ৩০০ কেজি
জিপসাম ১৬৫ কেজি
বোরিক এসিড ১২ কেজি
জিঙ্ক অক্সাইড ৪ কেজি
বেসাল সার সাকার রোপণের ৭ থেকে ১০ দিন আগে এবং গোবর/কম্পোস্ট অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন আগে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। রোপণের প্রায় ২৫ দিন পরে ইউরিয়া সারের অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার রোপণের ৪৫ দিন পর গাছের গোড়ার চারপাশে একটু দূর দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। উপরি প্রয়োগের পর সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সেচ প্রদান করতে হবে।
ফুল তোলা
পূর্ণ বিকশিত জারবেরা ফুলের বাইরের দুইসারি ডিস্ক ফ্লোরেট পুষ্পদন্ডের সঙ্গে সমকৌণিক অবস্থানে এলে ফুল তোলা হয়। কর্তনের সময় পুষ্পদন্ড যথাসম্ভব লম্বা রেখে ফুল সংগ্রহ করা হয়। ধারালো চাকু দ্বারা তেরছাভাবে কেটে খুব সকালে বা বিকালে ফুল তোলা উত্তম। ফুল কাটার পর পুষ্পদন্ড এক ইঞ্চি পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানির সঙ্গে অল্প চিনি এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে দিলে ফুল সতেজ থাকে।
ফলন
জাতভেদে ফলন কম-বেশি হয়। তবে প্রতি ঝাড় থেকে বছরে ২০ থেকে ২৫টির মতো ফুল পাওয়া যায়।
রোগ
বেশ কিছু রোগের আক্রমণ বা প্রাদুর্ভাবের ফলে জারবেরার চাষ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য চারা লাগানোর আগে বেডের মাটি জীবাণুমুক্ত করে নিলে রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রোগের নাম, রোগের কারণ ও দমন পদ্ধতি নিম্নে দেয়া হলো-
১. মূল পচা : মাটিবাহিত এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং অবশেষে সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে যায়। মাটি জীবাণুমুক্ত করে চারা লাগালে এ রোগ কম হয়।
২. গোড়া পচা : এটিও একটি মাটিবাহিত রোগ। এ রোগের ফলে গাছের কেন্দ্রীয় অংশ প্রথমে কাল বঙ ধারণ করে ও পরে পচে যায়। পরবর্তী সময় পাতা ও ফুল মারা যায়। রিডোমিল অথবা ডায়থেন এম-৪৫ (০.২ শতাংশ) নামক ছত্রাকনাশক ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায় অথবা টপসিন (০.০৫ শতাংশ) ব্যবহার করেও এ রোগ দমন করা যায়।
৩. পাউডারি মিলডিউ : দুই ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হতে দেখা যায়। রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি মাত্রায় হলে সমগ্র গাছটির উপরে সাদা পাউডারের আস্তরণ দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়। বেনোমিল ৫০ (ডবিস্নউ পি) ০.১ শতাংশ প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থা
সাদা মাছি
সাদা মাছি গাছের বিভিন্ন অংশের রস চুষে মারাত্মক ক্ষতি করে। এ মাছির মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণও হয়। চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন পর থেকে এসাটাফ ৭৫ (এসটি) ও কুমুলাস ডিএফ একসঙ্গে মিশিয়ে দুই গ্রাম করে প্রতি লিটার পানিতে দিয়ে ১০ থেকে ১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
মাইট
শুষ্ক উষ্ণ আবহাওয়ায় জারবেরাতে মাইটের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এদের আক্রমণে পাতা ও ফুলকুঁড়ির বৃদ্ধি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তার পরও যে ফুলগুলো হয়, অস্বাভাবিক আকার ও আকৃতির কারণে এগুলোর বাজারমূল্য থাকে না। ভারটিমেক ০.১ শতাংশ স্প্রে করে এ মাকড় দমন করা যায়