একটি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল। এই যড়যন্ত্র কতোদূর বিস্তৃত ছিল তা নিয়ে অনেক তথ্য এখনো অজানা। আরো গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে হয়তো আগামীতে এই বিষয়ে বিভিন্ন নতুন তথ্য জানা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন কথা ১৯৭৫-এর আগস্টের আগেই বিভিন্নভাবে শোনা যেতে থাকলেও, সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত তথ্য কখনো গোপন রাখা হয়েছিল, কখনো সেইসব তথ্যকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যারা ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ১৯৭৫-এর আগস্টের আগেই তাদের কারো কারো পরিচয় প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা ছিল। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর এই হত্যাকান্ড পরিচালনাকারী চাকুরীরত এবং প্রাক্তন সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে দ্রুত সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গিয়েছিল একই নিষ্ক্রিয়তা। আগস্ট হত্যাকান্ড পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে যে লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে তার আলোকে সেই ষড়যন্ত্র এবং নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে এই লেখায় কিছু তথ্য উপস্থাপন করবো।
ঢাকায় ১৯৭৪ সালের শেষভাগ থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এবং সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব শোনা যাচ্ছিলো (মাহমুদ আলী: ২০১০, পৃ-১১০।) সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলৎজ ১৯৭৯ সালে বৃটিশ সংবাদপত্র “গার্ডিয়ান”-এ তার একটি লেখায় উল্লেখ করেন যে, ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে কিছু বাংলাদেশী ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে কথা বলেন। লিফসুলৎজ এই বাংলাদেশীদের পরিচয় প্রকাশ করেননি। তবে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে খন্দকার মোশতাক-এর জড়িত থাকার প্রসঙ্গে লিফসুলৎজ এই বৈঠকসমূহের কথা উল্লেখ করেন। তার লেখায় তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এই বাংলাদেশীরা কোন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের প্রধান দুই পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস-এর সাথে সাক্ষাতকারে কোন বিদেশী মিশনের সাথে তাদের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছিলেন (ম্যাসকারেনহাস: ১৯৮৬, পৃ-৬৫।) মার্কিন দূতাবাসের সাথে যোগাযোকারী বেসামরিক ব্যক্তিরা বেশ ক’বার অনানুষ্ঠানিকভাবে মার্কিনী কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে মার্কিনীরা এই বাংলাদেশীদের সাথে আর আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ধারণা করা হয়, এই বাংলাদেশীরা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করার ব্যাপারে মার্কিন মনোভাব বোঝার ব্যাপারেই মার্কিনী কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেন। মার্কিনীরা এই বাংলাদেশীদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করেছিল কী না তা জানা যায় না। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এই গোপন বৈঠক সম্পর্কে কতোটুকু তথ্য পেয়েছিল তাও জানা যায় না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৭৫ সালে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেইসময়ের একমাত্র আর্মার্ড রেজিমেন্ট বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এর সহ-অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র অল্প কিছুদিন পূর্বে ফারুক মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশ থেকে কলকাতায় আসেন। যশোর মুক্ত হওয়ার পর ফারুক যশোরে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেন (হুদা: ২০১১, পৃ-১০৬।) যুদ্ধের পর তাকে নবগঠিত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ট্যাংক কোরের অফিসার ফারুক কিছুদিন পর ঢাকায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর একমাত্র ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এ অধিনায়ক হিসেবে বদলী হয়ে আসেন। অচিরেই তিনি সেনাবাহিনীতে রুশ-ভারত বলয়ের সমালোচনাকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মনোভাবটিও স্পষ্ট হতে থাকে (নাসির উদ্দিন: ১৯৯৭, পৃ- ৫০।) ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় ফারুক সরকার উৎখাতের ব্যাপারে তার এবং সেনাবাহিনীর অন্যান্য কিছু জুনিয়র অফিসারের চিন্তার কথা সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান-এর কাছে প্রকাশ করেন। লক্ষণীয়, ফারুক সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ’র সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা না করে জিয়াকে আস্থায় নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। সরকার পরিবর্তনের এই পরিকল্পনায় ফারুক জিয়ার সমর্থন এবং নেতৃত্ব চান। অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস-এর কাছে পরবর্তীতে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ফারুক জানান, জিয়া সরাসরি এই পরিকল্পনায় যুক্ত হতে অস্বীকার করেন, কিন্তু তিনি ফারুককে বলেন জুনিয়র অফিসাররা এমন কিছু করতে চাইলে তারা অগ্রসর হতে পারে। ১৯৭৬ সালে লন্ডনে মুজিব হত্যাকান্ড নিয়ে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান করার সময় ম্যাসকারেনহাস জিয়াকে ফারুক-এর এই বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে জিয়া ম্যাসকারেনহাস-এর প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকেন। ফারুকের সাথে তার এমন কথোপকথনের বিষয়টিও জিয়া তখন অস্বীকার করেননি (ম্যাসকারেনহাস: ১৯৮৬, পৃ-৫৪।) লক্ষণীয়, ১৯৭৫-এর মার্চে তার অধীনস্ত সেনা কর্মকর্তা ফারুকের কাছ থেকে এমন একটি পরিকল্পনার কথা শোনার পরও সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়া ফারুককে নিবৃত্ত বা গ্রেফতার করার চেষ্টা করেননি (মাহমুদ আলী: ২০১০, পৃ-১১১)।
১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিজিএস। মুজিব হত্যাকান্ডের প্রায় তিন মাস পর তার নেতৃত্বেই ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর ট্যাংক কোরের অপর একজন অফিসার মেজর নাসির উদ্দিন-এর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকেই খালেদ মোশাররফ ফারুকের সরকার বিরোধী অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনার ব্যাপারে অবহিত হয়েছিলেন। মেজর নাসির উদ্দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৩ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ট্যাংক কোরের অফিসার হিসেবে তিনিও বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মু্ক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর ফেলে যাওয়া তিনটি পুরনো এবং হালকা ধরনের মার্কিন এম-২৪ শেফী ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস্ যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত ৩০টি টি-৫৪ মিডিয়াম ট্যাংক উপহার দেন। ট্যাংকগুলির সাথে শ’চারেক গোলাও বাংলাদেশ পাঠানো হয়। ১৯৭৫-এর মার্চ মাসের মাঝামাঝি কোন এক রাতে গোলাসহ ৬টি ট্যাংক বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জীবন্ত গোলা বর্ষণ মহড়ার জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। মেজর ফারুকের ওপর দায়িত্ব ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্যাংকগুলো বিশেষ ট্রেনে তুলে দেয়ার কাজটি তদারক করা। ফারুক গভীর রাতে মেজর নাসিরের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাকে জানান যে তিনি ট্যাংক ট্রেনে না তুলে সেই রাতেই একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে চান। নাসিরকে তার প্রয়োজন কারণ বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এ চারশোর মতো মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক আছে যারা নাসিরের নির্দেশ মেনে নেবে। নাসির ফারুকের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ-কে ফারুকের উপস্থিতিতেই টেলিফোন করেন। খালেদ ফারুকের সাথে ফোনে কথা বলে তাকে নিবৃত্ত করেন এবং নাসিরকে নির্দেশ দেন ফারুকের সাথে কমলাপুর রেলস্টেশনে যেয়ে ট্যাংক ট্রেনে তোলা তদারক করার জন্য। খালেদ এও জানান ফারুক অন্যরকম কিছু করলে তিনি ফারুককে গ্রেফতারের জন্য মিলিটারী পুলিশ পাঠাবেন (নাসির উদ্দিন: ১৯৯৭, পৃ- ৫৮-৫৯)।
সেই রাতে ফারুকের এমন আচরণ দেখার পরও ফারুকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ বা মেজর নাসির কেউই সরকার, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ বা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে ফারুকের এমন পরিকল্পনার কথা আদৌ জানিয়েছিলেন কী না তা জানা যায় না। এছাড়া ঢাকা সেনানিবাসে আগে থেকেই একথা জানা ছিল যে, ফারুক ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর তখনকার তিনটি ট্যাংক নিয়ে একবার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তার সমর্থনে কুমিল্লা থেকে একটি সৈন্যদল ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই দলটি ঢাকায় এসে না পৌঁছায় ফারুকের পরিকল্পনা ভেস্তে যায় (জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১১৭।) ট্যাংক ব্যবহার করে একটি অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে ফারুকের এমন আগ্রহ এবং তৎপরতা সম্পর্কে সেনাবাহিনীর সব উর্দ্ধতন অফিসাররা অবহিত থাকার পরও ফারুকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী থেকে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং ফারুক সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এই সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এই রেজিমেন্টের ট্যাংকগুলির সাহায্যেই তার ভয়াল এবং নির্মম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন যার ফলে প্রাণ হারান শেখ মুজিবসহ আরো অনেকে।
শেখ মুজিব-এর ওপর হামলা হতে পারে এমন আভাস অবশ্য ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন সময় পাওয়া যেতে থাকে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে এসে জানান যে সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুর ওপর হামলা হতে পারে এমন সংবাদ তিনি পেয়েছেন। সেই রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি এবং শেখ মণি’র বাড়ির ওপর সতর্ক নজড় রাখা হয়। এর মাস দেড়েক পর একদিন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান প্রাপ্ত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করেন যে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা হতে পারে। আবারও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা রাতে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন (আলম: ২০১৩, ১২৮-২৯।) সেই সময় রাষ্ট্রপতির স্পেশাল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মাহবুব তালুকদার। ১৯৭৫-এর আগস্টের অল্পসময় আগে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত তার একজন পরিচিত ব্যক্তি উদ্বেগের সাথে তাকে জানান যে বঙ্গবন্ধুকে সরানোর গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই খারাপ কিছু একটা ঘটবে। তিনি মাহবুব তালুকদারকে অনুরোধ করেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত এই কথা জানানোর জন্য। সেই কর্মকর্তা অবশ্য তার এই দাবীর পক্ষে তৎক্ষণাৎ কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে না জানালেও, মাহবুব তালুকদার তার বন্ধু শেখ মণিকে এই কথা জানান। কিন্তু শেখ মণি গোয়েন্দা সংস্থার সেই কর্মকর্তার দেয়া তথ্যকে “আজগুবী খবর” বলে উড়িয়ে দেন (তালুকদার: ১৯৯২, পৃ-১৪২-৪৪।) বোঝা যায়, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন খবর কোনভাবে আঁচ করা গেলেও কারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত সেই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে তখন ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীরা দক্ষতার সাথে তাদের পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিলো।
সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সরকারকে কোন আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৫ সালে ডিজিএফআই-এর মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন একজন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট --- বেঙ্গল ল্যান্সারস্ আর মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট-এর সৈনিকদের। এই দুটি ইউনিটই ঢাকা’র ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। তখন এই ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল শাফায়াত জামিল। আগস্ট হত্যাকান্ডের মাস দুয়েক আগেই অজ্ঞাত কারণে ৪৬ ব্রিগেডের একমাত্র গোয়েন্দা ইউনিটটিকে প্রত্যাহার করে সেনা হেডকোয়ার্টারের অধীনে ন্যস্ত করা হয় (জামিল, পৃ-১১৯।) ফলে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারের তার নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট থেকে কোন তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ ছিল না। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড পরিচালনায় ফারুক-রশিদের অন্যতম সহযোগী তৎকালীন মেজর বজলুল হুদা নিজেই সেনাসদরে সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবন প্রহরায় নিয়োজিত ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আগত ১ম আর্টিলারী রেজিমেন্টের সৈনিকরা। সেনাসদরের নির্দেশেই কুমিল্লা থেকে এই রেজিমেন্টের সৈন্যদের ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রহরার জন্য আনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ পরিকল্পনার সাথে জড়িত মেজর হুদা আর মেজর ডালিম দু’জনই ছিলেন ১ম আর্টিলারী রেজিমেন্টের পুরনো অফিসার। ফলে, এই রেজিমেন্টের অনেক সৈন্যই ডালিম আর হুদার অনুগত ছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলায় হুদা অংশ নেয়। ধারণা করা হয়, আক্রমণকারীদের মধ্যে হুদার উপস্থিতি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রহরারত আর্টিলারীর সৈনিকদের আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় করে তোলে (হোসেন: ২০০৭, পৃ-২৫।) ধানমন্ডিতে আক্রমণে ব্যবহার করা হয় বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এর কিছু বাছাই করা সৈনিক যারা ছিল বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এবং ফারুকের প্রতি বিশ্বস্ত। ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ঘিরে ফেলে। যদিও এই ট্যাংকগুলিতে কোন গোলা ছিল না। কিন্তু ট্যাংক দেখে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধে অগ্রসর হয়নি।
ট্যাংকগুলোতে গোলা না থাকলেও রশিদের টু ফিল্ড আটিলারি ইউনিট থেকে প্রচুর গোলাবারুদসহ ৬টি ১০৫ মি.মি. হাউইটযার আক্রমণে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে যখন গোলাগুলি চলছিলো তখন একটি হাউইটযার দিয়ে বেশ কয়েক রাউন্ড গোলা বর্ষণও করা হয়, যার কিছু গোলা মোহাম্মদপুর অঞ্চলে যেয়েও ক্ষতিসাধন করে। মেজর রশিদ এই হামলার আগে ভারত থেকে গানারী স্টাফ কোর্স শেষ করে দেশে ফেরেন। এই কোর্স শেষ করার কারণে স্বাভাবিকভাবে আর্টিলারী ইন্সট্রাকটর হিসেবে তার পোস্টিং হয় যশোরে কম্বাইন্ড আর্মস স্কুলে। কিন্তু হঠাৎ করে তার পোস্টিং পাল্টে তাকে ঢাকায় বদলী করে নিয়ে আসা হয়। এই বদলীর পেছনে কার ভূমিকা ছিল তাও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। ৪৬ ব্রিগেডের অধীনস্ত সেনাবাহিনীর পদাতিক ইউনিটগুলিকে ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার পর সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলকে অভ্যুত্থানকারী ল্যান্সারস্ ও টু ফিল্ড আর্টিলারি’র সৈনিকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আদেশ দেননি। মুজিব হত্যাকারীদের প্রতিরোধ না করায় তৎকালীন রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার কর্ণেল খন্দকার নাজমুল হুদা (যাকে পরবর্তীতে খালেদ মোশাররফ-এর সাথে ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর হত্যা করা হয়) সফিউল্লাহ এবং সেনা সদরের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। নাজমুল হুদা তখন বলেছিলেন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান দেশে থাকলে হয়তো তিনি এই হত্যাকান্ড প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন (হুদা, পৃ-১১০।) উল্লেখ্য, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান এবং কর্ণেল নাজমুল হুদা দু’জনই বঙ্গবন্ধুর সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ১২ আগস্ট বিদেশ গিয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাদের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সেসময় ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ থাকতো পিলখানায় বিডিআর প্রধান কার্যালয়ে। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর রক্ষীবাহিনী পিলখানা থেকে তাদের অস্ত্র আনতে গেলে, তাদেরকে সেই অস্ত্র-গোলাবারুদ দেয়া হয়নি (আলম, পৃ-১৪৬।) রক্ষীবাহিনীকে তাদের অস্ত্র নিতে না দেয়া হলেও হত্যাকান্ডের পর ফারুকের গোলাবিহীন ট্যাংকগুলোর জন্য রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে গোলা আনার অনুমতি দেয়া হয়। জানা যায়, সেনাপ্রধানের নির্দেশে সিজিএস খালেদ মোশাররফ এই অনুমতি দেন (জামিল, পৃ-১০৭)।
সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে ফারুকের ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার কথা জানার থাকার পরও ফারুকের বিরুদ্ধে তৎকালীন উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা না নেয়া, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার এই আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে না পারা, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপারে খুবই বিশ্বস্ত সৈন্যদল নিয়োগ না করা প্রভৃতি কারণেই ১৯৭৫-এর আগস্ট হত্যাকান্ড সংঘটিত হতে পেরেছিলো। হত্যাকান্ডের পর সেনাবাহিনীর যে দুটি ইউনিট এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনী থেকে দ্রুত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিল-এর নেতৃত্বে মুজিব হত্যাকারী মেজরদের ট্যাংক ও কামানের বিরুদ্ধে পদাতিক বাহিনী ও বোমারু বিমান দিয়ে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। সেই অভিযানের প্রস্তুতি দেখেই ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্র সংঘাত-এর সাহস হারিয়ে ফেলে। ফারুকের ল্যান্সারস্ বাহিনীর সদস্যরা সেদিন পদাতিক বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে বঙ্গভবনে তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে (তালুকদার, পৃ-১৬৪।) দু’দিনের মধ্যেই ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া সেনা অফিসাররা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। প্রতিরোধের মুখে তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা কতোটা কম ছিল, এ থেকেই তা ধারণা করা যায়। তাই ট্যাংক বা কামানের কারণে ফারুক-রশিদের বাহিনীর অল্প কিছু সৈন্যের বিরুদ্ধে ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পরপরই শক্ত প্রতিরোধ গড়ে না তোলার যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয় না। কেন বঙ্গবন্ধুর ফোন পাওয়ার পরও সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তার অধীনস্ত সেনা ইউনিটসমূহকে দ্রুত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারলেন না, সেই ব্যাপারটি প্রশ্ন তৈরি করে। সেনাবাহিনীতে সফিউল্লাহর প্রভাবও কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বাধীন ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন ঢাকাতেই ছিল। হত্যাকান্ডের পর আক্রমণকারীদের দমন করার জন্য যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করার বিষয়টিও বিবেচনা করা হয়নি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিল নতুন সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দী করে ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, একই রকম শক্ত অবস্থান ১৫ আগস্টের পরপরই তারা গ্রহণ করেননি। কেন এই দু’জন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ এবং তাদের প্রতি অনুগত অন্যান্য অফিসার ও ইউনিটগুলোকে নিয়ে ধানমন্ডিতে হত্যাকান্ড ঘটার পরই ফারুক-রশিদ চক্রকে প্রতিরোধ করলেন না, তাও প্রশ্ন তৈরি করে। এই কথাই স্পষ্ট হয়, বৃহৎ এক ষড়যন্ত্রের জন্য এবং দায়িত্ব পালনে অনেকের নিষ্কিয়তার কারণেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-এর হত্যাকান্ডসমূহ দেশকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল।
সহায়ক গ্রন্থসমূহ:
S. Mahmud Ali. Understanding Bangladesh (New York: Columbia University Press, 2010)
Anthony Mascarenhas. Bangladesh: A Legacy of Blood (London: Hodder and Stoughton, 1986)
মেজর নাসির উদ্দিন, গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭)
কর্ণেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮)
মাহবুব তালুকদার, বঙ্গভবনে পাঁচ বছর (ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৫)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ (ঢাকা: পালক পাবলিশার্স, ২০০৭)
আনোয়ার উল আলম, রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩)
নীলুফার হুদা, কর্ণেল হুদা ও আমার যুদ্ধ (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১১)